শ্যামা পোকা মানে আপনি বুঝতেই পারছেন কোনটা বলছি—ওই যে ঘরের কোনে কোনে, জানালার পাশে বা টিনের নিচে গুছিয়ে থাকে, একটু শব্দ করলেই উড়ে আসে। অনেক সময় চোখে পড়ে না, কিন্তু ওদের ডানা ঝাপটানোর শব্দে বোঝা যায় আশেপাশে আছে। আর শ্যামা পোকা দেখা গেলে একটাও না, দল বেঁধেই থাকে। কেউ কেউ বলেন এগুলো নাকি তেলাপোকার মতোই বিরক্তিকর, আবার অনেকে ভয়ও পান, কারণ ওদের চলাফেরাও একটু হুটহাট।
স্যামা পোকা শুধু বিরক্তিকর না, বেশ কয়েকটা সমস্যাও করে। যেমন, ঘরে জমে থাকা পুরনো কাগজ, কাপড় বা অন্ধকার জায়গায় যদি এরা বাসা বাঁধে, তাহলে ধীরে ধীরে পুরো জায়গাটাকেই অপরিষ্কার আর বিশ্রী করে তোলে। আবার ছোট বাচ্চা থাকলে তো চিন্তার বিষয় আরও বেশি, কারণ বাচ্চারা খেলতে খেলতে এসব জায়গায় হাত দেয়, আবার কোনো পোকা কামড় দিলে সেটা নিয়েও ঝামেলা হতে পারে।
তবে চিন্তার কিছু নেই। একটু সচেতন হলেই এই শ্যামা পোকা তাড়ানো সম্ভব। আর এজন্য খুব বেশি খরচ করারও দরকার হয় না। ঘরেই থাকা কিছু জিনিস দিয়ে বা কিছু নিয়ম মানলেই এদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। নিচে আমি একদম সহজ ভাষায়, ধাপে ধাপে বলছি কীভাবে আপনি নিজেই শ্যামা পোকা তাড়াতে পারবেন।
শ্যামা পোকা কি? কেমন দেখতে?
শ্যামা পোকা বলতে আমরা সাধারণত যেসব ছোট্ট পোকামাকড়কে বুঝি, যাদের রঙ একটু গাঢ় বাদামী বা কালচে, ছোট্ট কিন্তু চোখে পড়ার মতো ডানা থাকে, তারা। এরা রাতে সক্রিয় হয়, দিনের আলোতে কম দেখা যায়। ওদের শরীর থরে থরে লম্বাটে এবং পেছনে ছোট্ট ডানা থাকে, যা দিয়ে ওরা একটু উড়তে পারে।
অনেকে শ্যামা পোকার নাম শোনামাত্রই ভয় পান, কারণ ওদের দেখতে অদ্ভুত লাগে আর মাঝে মাঝে হঠাৎ করেই ঘরে চুপচাপ থেকে হঠাৎ ঝাপট করে আক্রমণ করতে পারে।
শ্যামা পোকার হওয়ার কারণ
শ্যামা পোকা বাসা বাঁধে যেখানে খাবারের গন্ধ, আর্দ্রতা এবং গোপন জায়গা থাকে। যেমন:
- রান্নাঘর বা প্যান্ট্রিতে যেখানে খাবার সংরক্ষণ করা হয়
- ক্যান্টিন, দোকান কিংবা বাজারের আশেপাশে
- যেখানে পানি জমে থাকে বা আর্দ্রতা বেশি
- পুরনো কাগজ, কাপড়ের গাদা কিংবা ধুলো জমা জায়গায়
- ফাটল, ফোঁকড় বা ফাঁকা স্থান যেখানে লুকিয়ে থাকতে পারে
শ্যামা পোকা তখনই বেড়ে যায় যখন ঘর ময়লা, খাবারের টুকরো পড়ে থাকে আর অন্ধকার জায়গা বেশি থাকে।
শ্যামা পোকা কি কি ক্ষতি করে
শ্যামা পোকা শুধু চোখে বিরক্তিকর নয়, ওরা আপনার স্বাস্থ্য ও জিনিসপত্রের জন্যও ক্ষতিকর।
- ওরা খাবারে ময়লা ছড়িয়ে দেয়, এতে খাবার নষ্ট হয়।
- তাদের স্পর্শে বা কামড়ায় এলার্জি হতে পারে, বিশেষ করে বাচ্চাদের।
- শ্যামা পোকা বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া বহন করে, যা ডায়রিয়া, আলসার বা অন্যান্য রোগের কারণ হতে পারে।
- ওরা কাপড়, বই-পত্র কিংবা কাঠের জিনিসেও ক্ষতি করে।
শ্যামা পোকা তাড়ানোর উপায়
১. ঘর পরিষ্কার রাখা – এটাই সবচেয়ে বড় কাজ
এটা তো জানা কথাই, কিন্তু অনেকেই গুরুত্ব দেন না। শ্যামা পোকা এমনিতে খুব পরিষ্কার জায়গায় থাকতে চায় না। যেখানে অন্ধকার, গন্ধ, ধুলা-ময়লা, সেখানেই বেশি দেখা যায়। তাই আপনি যদি নিয়ম করে ঘরের কোণা, জানালার পাশে, দরজার ফাঁক এসব জায়গা মুছে পরিষ্কার করেন, তাহলে ওরা আর বাসা বাঁধবে না।
বিশেষ করে সন্ধ্যার সময় ঘরের আলো-আঁধারিতে শ্যামা পোকা বেশি বের হয়, তাই ওই সময়টায় যতটা সম্ভব জানালা-দরজা বন্ধ রাখুন আর লাইট জ্বালিয়ে রাখুন। কারণ আলোয় ওরা কম আসে।
২. পুরনো কাগজ, কাপড় বা অপ্রয়োজনীয় জিনিস জমিয়ে না রাখা
অনেক সময় আমরা পুরনো কাগজ, প্যাকেট, জামা-কাপড়, শাড়ির বাক্স এগুলো এক জায়গায় ফেলে রাখি, আর ভাবি পরে দেখা যাবে। কিন্তু এই জিনিসগুলোই শ্যামা পোকাদের সবচেয়ে প্রিয় জায়গা। ওরা সেগুলোর ভেতরেই ডিম পাড়ে, বাসা বাঁধে।
আপনি যদি এসব অপ্রয়োজনীয় জিনিস ফেলে দেন বা যেগুলো দরকার ওগুলো পরিষ্কার করে রাখেন, তাহলে ওরা বাসা বাঁধতে পারবে না।
৩. ঘরের ফাঁক–ফোঁকড় বন্ধ করা
অনেক সময় দেয়ালের ফাটল, জানালার ফ্রেমের পাশের ফাঁক, টিনের নিচের দিক বা দরজার চৌকাঠের নিচে জায়গা থেকে শ্যামা পোকা ঢুকে পড়ে। এভাবে ওরা একবার ভিতরে ঢুকতে পারলে, আর বের হয় না।
সেই কারণে ফাঁকফোঁকড়গুলো আপনি সিমেন্ট, সিলিকন বা পুরনো খবরের কাগজ দিয়ে বন্ধ করে দিন। যদি সম্ভব হয়, মিস্ত্রি ডেকে মেরামত করিয়ে নিন।
৪. নারকেল তেল আর কর্পূরের মিশ্রণ
এই টিপসটা খুবই সহজ আর অনেক জায়গায় কাজেও আসে। এক কাপ নারকেল তেলে কিছুটা কর্পূর মিশিয়ে সেটাকে এক বোতলে ভরে ঘরের কোণায়, দরজার পাশে বা যেখানে শ্যামা পোকা বেশি দেখা যায়, সেসব জায়গায় ছিটিয়ে দিন।
শ্যামা পোকা এই গন্ধ একদম সহ্য করতে পারে না। কয়েক দিন এই মিশ্রণ ব্যবহার করলে ওরা নিজেরাই সরে যাবে।
৫. নিমপাতার ব্যবহার
নিমপাতা এমনিতেই পোকা-মাকড় দূরে রাখতে খুব কার্যকর। কিছু শুকনো নিমপাতা পুড়িয়ে তার ধোঁয়া ঘরের ভেতরে দিলে শ্যামা পোকা দূরে থাকে। আবার আপনি চাইলে নিমপাতা পানিতে ফুটিয়ে, সেই পানি দিয়ে ঘর মুছেও নিতে পারেন।
নিমের গন্ধ শ্যামা পোকা সহ্য করতে পারে না, ফলে ওরা জায়গা ছেড়ে পালাবে।
৬. রসুন ও লবঙ্গ
রসুনের গন্ধও অনেক তীব্র হয়, আর শ্যামা পোকা এই গন্ধ একদম পছন্দ করে না। কয়েক কোয়া রসুন আর কয়েকটা লবঙ্গ একসাথে পিষে সেটা একটা ছোট পাত্রে রেখে দিন যেসব জায়গায় পোকা বেশি দেখা যায় সেখানে।
এতে শ্যামা পোকা ধীরে ধীরে দূরে সরে যাবে।
৭. রাতে খাবার খাওয়ার পর সব পরিষ্কার করে রাখা
এইটা অনেকেই করি না। রাতের বেলা ভাত বা তরকারির হাঁড়ি যেমন তেমনভাবে রেখে দিই, বা বাসন মেঝেতে ফেলে রাখি। কিন্তু খাবারের গন্ধই শ্যামা পোকাকে টেনে আনে। তাই রাতের খাবারের পর বাসন সব ধুয়ে ফেলুন, ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখুন।
জানালার ধারে বা রান্নাঘরে কোনো খাবার ফেলে রাখবেন না। টুকটাক জিনিসগুলোও ঢেকে রাখবেন, তাহলেই উপকার পাবেন।
৮. বাজারের পোকা তাড়ানোর স্প্রে
যদি ঘরে পোকা অনেক বেড়ে যায়, আর ঘরোয়া উপায় কাজ না করে, তাহলে বাজারে থাকা পোকা তাড়ানোর স্প্রে ব্যবহার করতে পারেন। তবে অবশ্যই খেয়াল রাখবেন যেন সেটা মানবদেহের ক্ষতি না করে।
স্প্রে করার সময় দরজা-জানালা বন্ধ রাখবেন, কাজ শেষ হলে ভালো করে বাতাস চলাচল করাবেন।
৯. বাচ্চা বা পোষা প্রাণী থাকলে বাড়তি সাবধানতা
যদি আপনার বাসায় বাচ্চা থাকে বা পোষা প্রাণী (বিড়াল, কুকুর) থাকে, তাহলে যেসব উপায় ব্যবহার করছেন সেটা যেন তাদের ক্ষতি না করে, সেটা খেয়াল রাখবেন।
কর্পূর বা স্প্রে জাতীয় কিছু ব্যবহার করলে, বাচ্চাদের ঘরে যেন সেটা না থাকে। সবসময় পরিষ্কার রাখবেন।
১০. পেশাদার পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিস
সবশেষে যদি সবকিছু চেষ্টা করেও আপনি শ্যামা পোকা তাড়াতে না পারেন, তাহলে আর দেরি না করে পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিসে যোগাযোগ করুন। কারণ অনেক সময় ঘরের ভিতরে কোথায় ওরা বাসা বেঁধেছে সেটা আমরা বুঝতে পারি না।
পেশাদার টিম এসে ঠিকমতো দেখবে, কোন জায়গা থেকে সমস্যা হচ্ছে, কী কী পদক্ষেপ নেয়া দরকার, আর আপনি যেন দীর্ঘ সময় ধরে পোকামুক্ত থাকতে পারেন সেটা নিশ্চিত করবে।
উপসংহার
শ্যামা পোকা তাড়ানো একদিনে সম্ভব না। তবে আপনি যদি একটু নিয়ম করে ঘর পরিষ্কার রাখেন, কিছু প্রাকৃতিক উপায় ব্যবহার করেন, আর অপ্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে রাখেন, তাহলে নিজেই দেখবেন ধীরে ধীরে পোকা কমে আসছে।
আর একটা বিষয় সবসময় মনে রাখবেন—পোকা মানেই অপরিচ্ছন্নতা না, কিন্তু যতটা সম্ভব পরিষ্কার থাকা মানেই পোকা দূরে রাখা।
আপনি যদি নিয়মিত এসব মেনে চলেন, তাহলে আপনার বাসা বা দোকান দুটোই থাকবে পোকামুক্ত, নিরাপদ আর শান্তিতে ভরা।
১. শ্যামা পোকা কি কখনো সম্পূর্ণ মরে যায়?
সঠিক পদ্ধতি ও নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও পেস্ট কন্ট্রোল করলে শ্যামা পোকা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসে, পুরোপুরি মরে যাওয়া সম্ভব না হলেও সমস্যা অনেক কমে যায়।
২. বাজার থেকে কেনা স্প্রে কি ঘর, শিশু বা পোষা প্রাণীর জন্য নিরাপদ?
সব স্প্রে নিরাপদ নয়, তাই ব্যবহার করার আগে লেবেল ভালো করে পড়ে নিন। শিশু ও পোষা প্রাণীর কাছ থেকে স্প্রে সরানোর পর ঘর ভালোভাবে বায়ুচলাচল দিন।
৩. শ্যামা পোকা বাড়ি থেকে কীভাবে দূরে রাখা যায়?
ঘর পরিষ্কার রাখা, খাবার ঢেকে রাখা, আর্দ্রতা কমানো, ফাঁক-ফোঁকড় বন্ধ করা এবং নিয়মিত নিমপাতা বা কর্পূর ব্যবহার করা সবচেয়ে কার্যকর।